সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
ঠিক এক বছর আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু যে কর্মপদ্ধতির কথা ভেবেছিল কমিশন তার অনেককিছুই বদলে গেছে। মহানগর আর জেলা সদরের দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরায় নজরদারির লক্ষ্য ঠিক করেছিল যা এখন আর নেই। ব্যালটেই হচ্ছে নির্বাচন। লাখ লাখ কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারিও অবাস্তব ধারণা।
সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায় কমে গেছে। গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হলে নির্বাচন কমিশন পুরো নির্বাচনই বাতিল করে দেয়। এরপরই আমরা দেখলাম সরকার আরপিও সংশোধন করে কমিশনের এই পুরো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা ছেঁটে ফেলে দুই একটি কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করার ক্ষমতা দেয়।
এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনকে আর কয়েকমাস পরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে যে নির্বাচন নিয়ে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে দেশে। বিএনপিসহ সমমনা ৩০টিরও বেশি দল এক দফার আন্দোলন করছে যে সরকারকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। অন্যদিকে শাসক দল আওয়ামী লীগ নিজে এক দফায় আছে শেখ হাসিনার অধীনেই হবে নির্বাচন।
বিএনপি মাঠের আন্দোলনে আছে, তারা নির্বাচন কমিশনকেও মেনে নেয়নি। একটি সংলাপেও বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ যায়নি। সংলাপে যায়নি সিপিবি, বাসদসহ আরও অনেক দল। ফলে বড় ধরনের একটি আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। কমিশনের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তা করতে গেলে নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা।
২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা করতে চায় নির্বাচন কমিশন। সহিংস এবং সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কার মাঝেই ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, নির্বাচন কমিশন ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক কর্মশালার আয়োজন করে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশা ও বাস্তবতা বুঝতে বিশিষ্টজনদের ডেকে নিয়ে যায় কমিশন। কিন্তু সভাটি সুখকর ছিল না প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়ালের জন্য।
বিএনপি মাঠের আন্দোলনে আছে, তারা নির্বাচন কমিশনকেও মেনে নেয়নি। একটি সংলাপেও বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ যায়নি। সংলাপে যায়নি সিপিবি, বাসদসহ আরও অনেক দল…
পুরো কর্মশালাতেই সিইসি অনেক অস্থির প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন। কর্মশালায় পর্যালোচক হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ধারণা, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনীর মাধ্যমে ইসি নিজেদের ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে। আরপিও সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন নিজেদের ক্ষমতা কেন কমালো। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, সিইসির সক্ষমতা আরও বাড়বে। ইসির ক্ষমতা বাড়ার বদলে কমেছে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষ হতাশ। এই বক্তব্যের মাঝখানেই কথা বলেন সিইসি হাবিবুল আউয়াল এবং বলেন তাদের সক্ষমতা কমেনি।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন, নির্বাচন আমাদের জন্য খুব সহজ নয়। আমরা একটা কঠিন অবস্থায় আছি। আমাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ রাজনীতিবিদেরা যদি তৈরি করে না দেন, তাহলে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করাটা কষ্টসাধ্য হবে।
তার এই কথাতেই আগামী নির্বাচনকে ঘিরে পরিস্থিতি ও পরিবেশ সম্পর্কে আঁচ করা যায়। যদি কমিশন বলে যে কঠিন অবস্থায় আছে তাহলে আস্থার সংকট অনুভূত হয়। এই কর্মশালাতেই বিশিষ্টজনরা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে জাতিকে মাশুল দিতে হবে। তারা এও বলেছেন যে, বিএনপি’র মতো একটি বড় দল যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে আরও অনেক দল এলেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ এবার অনেক গভীরভাবে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচনকে দেখবে।
উঠে আসে আওয়ামী লীগের জন্য ভোট চাওয়া জামালপুরের জেলা প্রশাসক প্রসঙ্গও এবং তারা অনেকেই বলেন এরকম রিটার্নিং অফিসার দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দুটি বড় বাধা এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার সংকট। রাজপথের বিরোধী দলগুলো রাজপথেই ফয়সালা করতে চায় তাদের দাবি। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের চাপ।
দেশের রাজনীতিতে বিদ্বেষ ও বিভাজন স্পষ্ট থাকায় এবং সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দৃশ্যমান না হওয়ায় বিদেশিরা কথা বলছে আমাদের নির্বাচন নিয়ে। সরকার এবং সরকারি দলের নেতারাও বলছেন নির্বাচন যথাসময়ে হবে এবং সুষ্ঠুভাবে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্যে গাজীপুর নির্বাচনের আগে আগে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের জন্য যেটি একটি খড়গ হিসেবেই উপস্থিত নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের জন্য। এর আগে ২০২১ সালে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর স্যাংশন আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলো সবই এখন বড় রাজনৈতিক আলোচনা দেশে।
দেশের রাজনীতিতে বিদ্বেষ ও বিভাজন স্পষ্ট থাকায় এবং সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দৃশ্যমান না হওয়ায় বিদেশিরা কথা বলছে আমাদের নির্বাচন নিয়ে। সরকার এবং সরকারি দলের নেতারাও বলছেন নির্বাচন যথাসময়ে হবে এবং সুষ্ঠুভাবে হবে। কিন্তু বিরোধী দল আস্থায় নিতে পারছে না, কারণ ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হলে যে ধরনের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন তারা মনে করছে তা নেই।
জনপ্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দলীয়করণের অভিযোগ করছে তারা। ফলে তারা বলছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।
সরকারি দলের নেতারা বলছে, তারা ভালো নির্বাচন উপহার দিতে চায় তাদের দলের অধীনেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন তিনি আস্থা রাখতে চান। এই চাওয়াটা তিনি চাইতেই পারেন কিন্তু সময় বলে দিবে কতটা তিনি পেরেছেন।
একটি প্রশ্ন অবশ্য করতেই হয়—আর কতকাল রাজনীতিকরা নিজেদের প্রতি আস্থা না রেখে অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক উপদেষ্টাদের দিয়ে নির্বাচনের মতো সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কর্ম সম্পাদন করবেন?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।